স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াসঃ যার ওপারে প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘিত হয় সবসময়।
ব্ল্যাকহোলে কেন্দ্র থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলি আমাদের কাছে যেটা স্বাভাবিক সে অনুসারে কাজ করতে পারে। এই দূরত্বের শুরুটাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজোন, যার ওপারে কিছু গেলে আর ব্ল্যাকহোলের থাবা থেকে ফেরত আসতে পারবেনা।কেন্দ্র থেকে ঐ দূরত্বের যা দৈর্ঘ্য তাকে বলা স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস।
আইনস্টেইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ড ১৯১৬ সালে একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল "কোন বস্তুকে কতটুকু ঘনীভূত করলে সেখানে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকানুন ভেঙে পড়বে?" তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কাজ শুরু করে দেন। তাঁর কাজে প্রকাশ হয় যে গ্র্যাভিটির একটি সীমা আছে যাতে প্রকৃতির সব ধরণের বল অকেজো হয়ে যায়, যা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করে। যে বিন্দুতে এটা শুরু হয় সেখানে স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস'র শুরু। এটা আসলে ব্ল্যাকহোলের প্রবল গ্র্যাভিটির সবচেয়ে বাইরের সীমানা। এই সীমানা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যেসব তথ্য আছে তা সংগ্রহ করা অসম্ভব। যেই এই অংশটিকে মহাকাশ থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে।
কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ড |
যাইহোক, ব্ল্যাকহোল নিয়ে অসংখ্য গল্প আছে যার শুরু ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে। জন মিশেল নামে একজন অখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর কাছে একটি টরশনাল ব্যালান্স (নিক্তি) ছিল, যা দিয়ে কোন বলের পরিমাণ প্রায় সঠিকভাবে পরিমাপ করা যেত। তিনি এই যন্ত্রটি দিয়েছিলেন হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে। তিনি এটা দিয়ে প্রথম সঠিকভাবে পৃথিবীর ভর পরিমাপ করেছিলেন। পরে চার্লস অগাস্টিন ডে কুলম্ব একটি টরশনাল ব্যালান্স ব্যাবহার করে যা দিয়ে তড়িৎ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বলের পরিমাণ বের করেন। হাইটেক টরশনাল ব্যালান্স দিয়ে এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপ করা হয়। মিশেল ছিলেন প্রথম ব্যাক্তি জিন ধরনা দেন যে এমন বস্তুও প্রকৃতিতে থাকতে পারে যা থেকে কিছুই বেরিয়ে আসতে পারেনা এমনকি আলোও না। তিনি এমন বস্তুর গ্র্যাভিটির পরিমানের একটি হিসাবও প্রকাশ করেন। যদিও তিনি যে হিসাব দিয়েছিলেন তা একদম সঠিক ছিলনা। কারণ তিনি একে তো নিউটনের সুত্র নিয়ে কাজ করেছেন, আইনস্টেইনের নয় আর সে সময় আলোর গতির পরিমাণ আবিষ্কার হয়নি। মহাকাশের এমন পশু, ব্ল্যাকহোলের ব্যাপারে প্রথম ধারণা দিয়ে তিনি প্রশংসা পেতেই পারেন।
এর প্রায় এক শতাব্দী পরে কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ড সঠিকভাবে একটি ব্ল্যাক হোলের আকার ও সেটার ভরের সাথে সম্পর্ক প্রকাশ করে। সালটা ছিল ১৯১৬, তিনি তখন রাশিয়ান ফ্রন্টের একজন সৈনিক। কিন্তু তিনি অন্য সৈনিকদের মত ছিলেন না। জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের একজন ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর হিসেবে চল্লিশ বছরেরও বেশী বয়সে তিনি জার্মান সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হন। সেই সময় আলবার্ট আইনস্টেইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন। কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ড এটার একটি কপি শুধু সংগ্রহই করেননি, যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা অবস্থায় এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণাও করেন। তিনি যুদ্ধে অক্ষত থাকেন কিন্তু দুঃখজনকভাবে পেম্ফিগাস নামে একটি রোগে আক্রান্ত হন এবং এক বছরের মাঝেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু মারা যাবার আগে একটি কাজ শেষ করে যান যা তাঁর নাম এখনও বহন করছে।
কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ড দেখান যে যেকোন ভরের বস্তুই ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে পারে যদি তাকে উপযুক্ত স্থানের মাঝে ঘনীভূত করা সম্ভব হয়। এটা একটা গোলকে পরিণত হবে যার ব্যাসার্ধকে বলা হয় স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস। এই ব্যাসার্ধ বের করতে আপনার যা যা লাগবে তা হলঃ
১। বস্তুটির ভর, M।
২। আলোর গতি, c যার মান 299,792,458 metres/second
৩। মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, G যার মান 6.67 × 10-11 Newtons kg-2 m2
আর বের করার সুত্রটি হলঃ
একটা ১ কেজি ভরের আপেলকেও ব্ল্যাকহোল বানানো সম্ভব যদি সেটাকে ০.০০০০১৪৮ মিটার ব্যাসার্ধের একটি গোলকের মাঝে ঘনীভূত করা সম্ভব হয়। পৃথিবীও ব্ল্যাকহোল হয়ে যাবে যদি এটাকে প্রায় ১ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের কোন গোলকের মাঝে ঘনীভূত করা হয়।
কার্ল স্কোয়ারজচাইল্ডের কাছে ব্ল্যাকহোল ছিল শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক সম্ভবনা, কোন বাস্তব বস্তু নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে প্রমাণিত হয় যে যে কোন নক্ষত্র যার ভর সূর্যের চেয়ে প্রায় বিশ গুণ বা এর বেশী নিজের মাঝে ঘনীভূত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। যে ভরের কথা মিশেল বলে ছিলেন এই ভর তার চেয়ে অনেক কম।
স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস কি ব্ল্যাকহোল কত বড় তা বলে? উত্ত হ্যাঁ বা না দুটোই। তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা মনে করেন যে সব বস্তু ব্ল্যাকহোলে পতিত হয় তা আসলে শেষ পর্যন্ত একটি বিন্দুতে গিয়ে পৌছায়, যাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। কোথাও এই বিন্দুর চেয়ে ছোট বিন্দু হওয়া অসম্ভব। সিঙ্গুলারিটি স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াসের ভেতরে অবস্থান করে। এই রেডিয়াস আরও বলে দেয় ব্ল্যাকহোলটির ঘনত্ব কেমন। যদিও সিঙ্গুলারিটি বিন্দুটির ঘনত্ব অসীম। ব্ল্যাকহোলের ঘনত্ব বের করা যাবে যদি এর ভরকে তার আয়তন দিয়ে ভাগ করা যায়। এই হিসাবে পৃথিবীকে ব্ল্যাক হোল হতে গেলে তার ঘনত্ব হতে হবে প্রায় ছয় সেক্সটিলিয়ন ( একের পর ২১টি শূন্য ) প্রতি ঘনইঞ্চি। ব্ল্যাক হোল যত বড় তার ঘনত্ব তত কম। কারণ স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস নির্ভর করে ব্ল্যাকহোলটি কত বড় তার উপর। ভর দ্বিগুণ হলে ব্যাসার্ধও দ্বিগুণ হবে। কিন্তু ঘনত্ব হল ভর/আয়তন। গোলকের আয়তন পাওয়া যাবে যদি তার ব্যাসার্ধকে ঘন করা হয়। যদি গোলকের ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হয় তার আয়তন বাড়ে আটগুণ। তার মানে হল বড় ব্ল্যাকহোলটির ঘনত্ব ছোট ব্ল্যাকহোলটির চার ভাগের এক ভাগ হবে। তাই কোন ব্ল্যাকহোলের স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস যদি দ্বিগুণ হয় তবে তার ঘনত্ব কমবে চার গুণ করে।
এ থেকে একটি খুব সাধারণ কিন্তু অবাক করা তথ্য বেরিয়ে আসে। কোন ব্ল্যাকহোলের স্কোয়ারজচাইল্ড রেডিয়াস, যার ভর ঐ ব্ল্যাকহোলের গ্যালাক্সীর সম্পূর্ণ ভরের সমান, এতটাই বেশী যে ঐ ব্ল্যাকহোলের ঘনত্ব পৃথিবীর বাতাসের ঘনত্বের প্রায় এক হাজার ভাগের এক ভাগ।
যা এতক্ষণ পড়লেন তা হয়ত ব্ল্যাকহোল নিয়ে আপনার চিন্তার মাঝে ছিলনা।
তা হলে কৃষ্ণগহ্বর এর ঘনত্ব যে সবসময় অনেক বেশী হতে হবে এমনটা নয়,তাই না?
ReplyDeleteহ্যাঁ।
Delete