একটি নিউট্রন স্টারের হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্র।
নৃতত্ত্ববিদেরা যেমন মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ এক এক করে জোড়া লাগিয়ে মানুষের উদ্ভবের নেপথ্য জানতে পারে তেমনি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি অদ্ভুত কংকাল পেয়েছেন যা হয়ত দুটি ভিন্ন ধরণের মহাজাগতীয় বস্তুর যোগসূত্র। একটি রহস্যময় জিনিস, নাম PSR J1119-6127, দুটি ভিন্ন জিনিসের ধর্ম দেখায়, একটি রেডিও পালসার এবং একটি ম্যাগনেটার।
একটি রেডিও পালসার এক ধরণের নিউট্রন স্টার যা আসলে খুবই বেশী ঘনত্বের তারার ধ্বংসাবশেষ। রেডিও পালসার তার অত্যন্ত দ্রুতগতির ঘূর্ণনের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর রেডিও ওয়েভের পালস নির্গমন করে। অন্যদিকে ম্যাগনেটার খুবই অস্থির, প্রতি মুহূর্তে উচ্চ শক্তির এক্স-রে ও গামা রে বিকিরণ করে। এদের চৌম্বকক্ষেত্র মহাকাশের বস্তুগুলির ভেতর জানা সবচেয়ে উচ্চ শক্তির। নাসা'র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরী, পাসাদানা, ক্যালিফোর্নিয়ার জ্যোতিপদার্থবিদ ওয়ালিদ মাজিদ বলেন "এই নিউট্রন স্টারটি দুই ধরণের চরিত্র দেখায়। এক সময় এটি একটি পালসার, আরেক সময় এটি ম্যাগনেটার। এই নিউট্রন স্টার থেকে আমরা হয়ত পালসারে কর্মপ্রক্রিয়া কি সেটা জানতে পারব।"
১৯৭০ সালের দিক থেকে পালসার ও ম্যাগনেটারকে দুটি আলাদা বস্তু বলে বিবেচনা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু গত দশকে এই দুটি বস্তু বিবর্তিত হয়ে একটি নতুন বস্তুতে পরিণত হবার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাজিদের গবেষণা এবং আরও অনেক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটা প্রস্তাবিত হয় J1119 হয়ত রেডিও পালসার ও ম্যাগনেটার মাঝখানে কোন একটি বস্তুতে পরিণত হয়। এই গবেষণা এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস এর জানুয়ারীর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে গ্রেপভাইন, টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এমেরিকান এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি'র মিটিংয়ে এটির উপস্থাপন হয়।
"এটিই পালসার ও ম্যাগনেটারের মাঝে যোগসূত্র পাওয়ার শেষ সুযোগ।" বলেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিল, কানাডা'র জ্যোতিপদার্থবিদ ভিক্টোরিয়া কাসপি। "মনে হয় দুই ধরণের নিউট্রন স্টারের মাঝে কোন সাম্যাবস্থা আছে যা খুবই শান্ত।" যখন ২০০০ সালে এই রহস্যময় বস্তুটি আবিষ্কার হয় তখন এটি রেডিও পালসার হিসেবে দেখা গিয়েছিল। তখন এটা ছিল খুবই শান্ত এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভবিষ্যৎবাণী করা যেত। কিন্তু সেই বছরই ফারমি ও সুইফট স্পেস অবজারভেটরীতে দুটি এক্স-রে বারস্ট এবং আরও দশটি কম শক্তির সাধারণ আলোর বারস্ট এই জ্যোতিষ্ক থেকেই আসছে বলে ধরা পড়ে। তখন তার আচরণ ম্যাগনেটারের মত বলে প্রকাশ করেন রবার্ট আরকিবাল্ড। যখন আউটবারস্টগুলি ঘটে কাসপি বেশ উত্তেজনার সাথে জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরী, পাসাদানা, ক্যালিফোর্নিয়ার জ্যোতিপদার্থবিদ টম প্রিন্স এর কাছে ইমেইল করেন। বলেন দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে এটা গবেষণার জন্য বেশ ভালো বিষয়বস্তু। এজন্য প্রিন্স, মাজিদ এবং তাদের সহকর্মীরা অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবস্থিত নাসা'র ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের ৭০ মিটার রেডিও টেলিস্কোপ ব্যাবহার করেন। এটিই দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ। মাজিদের মতে এক্স-রে আউটবারস্ট হয় বস্তুটির অসম্ভব শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের জন্য। যখন বস্তুটি ঘোরে তখন তার চৌম্বকক্ষেত্রে ভাজ পড়ে। এই ভাজের ফলে এতটাই পীড়ন হয় যে নিউট্রন স্টারের পৃষ্ঠ ভেঙ্গে যেতে থাকে। অনেকটা পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের মত যার কারণে পৃথিবীতে ভুমিকম্প হয়। এটার কারণে ঘূর্ণনে অনিয়মিত পরিবর্তন হয়। এটাকে গ্লিচ বলে।NuSTAR'র সাহায্যে এর পরিমাপ করা হয়।
নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এতোটাই বেশী যে একটি চাচামচের ভর হবে একটা পর্বতের ভরের সমান হবে। তারাটির পৃষ্ঠ মোটামুটি এক কিলোমিটার মোটা। এটির পুরোটাই নিউট্রনের তৈরি। যত গভীরে যাওয়া যায় চাপ তত বাড়তে থাকে। জানা পালসার গুলির মাঝে এই পালসারের চৌম্বকক্ষেত্র অন্যতম শক্তিশালী। আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় কয়েক ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী এই নিউট্রন স্টারটি।
আউটবারস্টের দুই সপ্তাহ পড়ে মাজিদ ও তার সহকর্মীরা বস্তুটির বিকিরণ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সীতে ধরে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী এক্স-রে'র চেয়ে কম শক্তিশালী। এই রেডিও বিকিরণের বেশ দ্রুত ওঠানামা ধরা হয়। এতে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে বিকিরণের পরিমাণ কত। গবেষকেরা একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন যার নাম পালসার মেশিন। যন্ত্রটি ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের ৭০ মিটার রেডিও টেলিস্কোপের সাথে যুক্ত করে ব্যবহার করা হয়। "মাত্র দশ দিনের মাঝে বস্তুটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রেডিও পালসারের মত আচরণ শুরু করে।" বলেন মাজিদ।
প্রশ্ন থেকে যায় কোনটা প্রথমে আসে? পালসার না ম্যাগনেটার? কিছু বিজ্ঞানী বলেন যে J1119 শুরুতে ছিল একটা ম্যাগনেটার। আস্তে আস্তে তার এক্স-রে ও গামা রে বারস্টের পরিমাণ কমে আসে। কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী সম্পূর্ণ বিপরীত প্রস্তাব দেন। প্রথমে বস্তুটি রেডিও পালসার ছিল। সময়ের সাথে সাথে এর সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষ থেকে এর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয় এবং তখন থেকে তার ম্যাগনেটারের মত আউটবারস্ট শুরু হয়।
বিজ্ঞানীরা J1119 কে পর্যবেক্ষণ এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
No comments