পৃথিবী থেকে মানুষ এমনকি প্রাণ নিশ্চিহ্ন হবার ছয়টি সম্ভাব্য মহাজাগতিক কারন।
যদি নিজেকে প্রশ্ন করেন মানব জাতির ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কি? আপনি হয়ত পারমাণবিক যুদ্ধ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ব্যাপক আকারে কোন রোগের মহামারির কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু মনে করুন আমরা এসব সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারি, তারপরও কি আমরা নিরাপদ? আমাদের ছোট্ট নীল গ্রহে বাস করা অনেক নিরাপদ মনে হবে যতক্ষণ না আপনি জানছেন মহাকাশে কি কি বিপদ ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিচের কয়েকটি মহাজাগতিক দুর্যোগ মানব জাতির টিকে থাকাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হুমকির মাঝে ফেলতে পারে এমন কি সম্পূর্ণ প্রাণেরও বিলুপ্তি ঘটাতে পারে।
১। উচ্চ শক্তির সৌরঝড়।
আমাদের সূর্য কিন্তু মোটেও একটি শান্তশিষ্ট নক্ষত্র নয়। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এই কারণে সেখানে অসাধারণ সৌরকলঙ্ক তৈরি হয়। এসব সৌরকলঙ্ক আকারে মাঝে মাঝে পৃথিবীর চেয়ে কয়েকগুন বড় হয়। এগুলো থেকে চার্জড ্পারটিকেলের ধারা এবং তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায় - যা সৌর বাতাস হিসেবে পরিচিত। আমাদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে সৌর বাতাস বাধা পেয়ে দুই মেরুতে মেরুজ্যোতি তৈরি করে। কিন্তু এটি যদি অনেক শক্তিশালী হয় তবে তা আমদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক বাধা তৈরি করতে পারে এমনকি বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে যেতে পারে। রেকর্ড অনুসারে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড় আঘাত হেনেছিল ১৮৫৯ সালে। ঘটনাটি ক্যারিংটন ইভেন্ট নামে পরিচিত। এই ঝড়ে ছোট ছোট ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতিতেও সমস্যা হয়েছিল। এমন ঘটনা বা তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী সৌরঝড়ের কবলে হয়ত এর আগেও পৃথিবী অসংখ্যবার পড়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। সত্য হল আমারা যদি ভবিষ্যতের এই সব ক্যারিংটন ইভেন্টগুলির ব্যাপারে প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিতে পারি তবে আমাদের যথেষ্ট বড় বিপদে ভুগতে হবে। যদি এটা সাথে সাথেই মানব জাতির বিলুপ্তি নাও ঘটায় তারপরও এটা মানব জাতিকে পুরোপুরি ভাবে উঠে দাড়াতে না পারার মত ক্ষতি সাধন করতে পারে। থাকবেনা কোন ইলেক্ট্রিসিটি, শীতের সময় ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা, জিপিএস বা ইন্টারনেট এমনকি খাবার ও ওষুধের প্রাপ্তিও হুমকির মুখে থাকবে।
২। গ্রহাণুর পতন।
আমরা এখন বিপদজনক গ্রহাণু যেগুলো আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে সেগুলি সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজ খবর রাখি। এসব গ্রহাণুর পতন প্রতিরোধ করার জন্য আমরা এখন প্রযুক্তি আবিষ্কারের চেস্টা করছি। এখনকার প্রযুক্তি দিয়ে হয়ত ছোট গ্রহাণু প্রতিহত করা যাবে কিন্তু বড় গ্রহাণুর পতন ঠেকাতে আমরা এখন পর্যন্ত অসহায়। হয়ত এগুলির পতন পৃথিবীকে ধ্বংস করতে না বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারবেনা কিন্তু এগুলো মানব জাতির বিলুপ্তির জন্য মঞ্চ তৈরি করতে পারে পতনের সময় সৃষ্টি হওয়া ভয়ঙ্কর সুনামি, দাবানল এমনকি অন্যান্য মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগও তৈরি করতে পারে।
৩। সূর্যের প্রসারণ।
আমারা প্রায় নিশ্চিত যে আমদের সূর্য আগামী প্রায় ৭.৭২ বিলিয়ন বছরের মাঝে জীবন হারিয়ে ফেলবে। এসময় সূর্য তার বাইরের স্তর বিস্ফোরিত হয়ে প্ল্যানেটারী নেবুলা তৈরি হবে। তারপর সূর্য সাদা বামন হয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াবে যার কোন তাপ থাকবেনা। কিন্তু মানব জাতির এটা দেখার সৌভাগ্য হবেনা। সূর্যের বয়স যত বাড়বে এটি তত ঠান্ডা ও বড় হতে থাকবে। একসময় এটি এতটাই বড় হয়ে যাবে যে সূর্যের বাইরের স্তর শুক্রের কক্ষপথেরও দূর পর্যন্ত প্রসারিত হবে। পৃথিবী হয়ত এ পর্যন্তও নিরাপদ থাকবে। কিন্তু সূর্য যে প্রতিনিয়ত সৌর বাতাস তৈরি করে সেটি পৃথিবীর গতি কমিয়ে দেবে। এর ফলে এখন থেকে প্রায় ৭.৫৯ বিলিয়ন বছরের ভেতর আমাদের পৃথিবী সূর্যে পতিত হবে।
৪। কাছাকাছি গামা রে বারস্ট।
অত্যন্ত উচ্চমাত্রার শক্তির আউটবারস্টকে গামা রে বারস্ট বলে। সাধারণত বাইনারী স্টার সিস্টেম ও সুপারনোভা থেকে গামা রে বারস্টের উৎপত্তি হতে পারে। এই বারস্ট গুলি খুবই শক্তিশালী তার কারন হল এই বারস্ট একটি বীমে ঘনীভূত হয়ে ছড়ায়। এসব বীম সাধারণত কয়েক সেকেন্ড সর্বচ্চো এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এরকম একটি মাত্র বীম পৃথিবীর ওজোন স্তরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে সেই সাথে পৃথিবীর প্রানীদের সূর্যের অত্যন্ত ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির কবলে পড়তে কোন বাধা থাকবেনা।
বিজ্ঞানীদের মতে WR-104 স্টার সিস্টেম এরকম একটি ঘটনা ঘটাতে পারে। এটি প্রায় ৫,২০০ থেকে ৭,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে, যেটা গামা রে বারস্ট থেকে বাচার জন্য মোটেই নিরাপদ দূরত্ব নয়। আমরা শুধু অনুমান করতে পারে কখন এটি ঘটতে পারে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে গামা রে বীম পৃথিবীকে সম্পূর্ণ মিস করতে পারে।
৫। কাছাকাছি সুপারনোভা।
একটি তারা যখন তার জীবনকালের শেষ মুহূর্তে চলে আসে তখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। আমাদের মিল্কিওয়েতে প্রতি ১০০ বছরে গড়ে একটি বা দুটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়। সেগুলিও ঘটার সম্ভবনা থাকে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের দিকে যা পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে।
আমরা কি কাছাকাছি সময়ের ভেতর কোন সুপারনোভা বিস্ফোরণের আশঙ্কা করতে পারি? বেটেলজুস নক্ষত্র, এটি একটি রেড সুপার জায়ান্ট নক্ষত্র, তার জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্তে চলে এসেছে। এর অবস্থান ওরায়ন কন্সটিলেশনে এবং পৃথিবী থেকে প্রায় ৪৬০ থেকে ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি এখন বা আগামী মিলিয়ন বছরের ভেতর বিস্ফোরিত হতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর কোন রকম ক্ষতি হবার জন্য প্রায় ৫০ আলোকবর্ষের মাঝে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হতে হবে। তাই মনে হয়না এই মুহূর্তে সুপারনোভা বিস্ফোরণ মানব জাতির জন্য কোন বড় হুমকি।
৬। চলমান নক্ষত্র।
মহাজগতিক সময়ের খুবই সাম্প্রতিক সময়ে একটি নক্ষত্র সৌরজগতের একদম বাইরের অংশ অরট ক্লাউডকে প্রায় স্পর্শ করে যেতে পারে। অরট ক্লাউড হল সৌরজগতের ধুমকেতুর উৎস। এই নক্ষত্রের কাছে আসার কারণে পৃথিবীতে বড় বড় ধুমকেতু বা গ্রহাণুর পতনের হার বেড়ে যাবে।
সূর্য মিল্কিওয়েকে যে পথ দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে তাতে বিভিন্ন সময়ে পদার্থের মাত্রার পরিবর্তন হয়। এখন আমরা যেখানে আছি সেটি একটি কম ঘনত্বের গ্যাসের বাবল যা একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে সৃষ্ট। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র হিলিওস্ফিয়ার নামের একটি গোলকের মত অবস্থার সৃষ্টি করেছে যেটা এই সব গ্যাসকে সৌরজগতের ভেতরের দিকে আসতে দেয়না। আজ থেকে প্রায় ২০,০০০ বা ৫০,০০০ বছর পর সূর্য বর্তমান জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাবে তখন সূর্যের হিলিওস্ফিয়ারের সক্ষমতা করে যাবে এবং বাইরের গ্যাস সৌরজগতের আরও ভেতরে ঢুকে আসবে। তখন হয়ত মানব জাতি আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন খেয়াল করবে যা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপও হতে পারে।
এবং জীবন চলবে....
পৃথিবীতে মানব জাতির যে আজ হোক বা কাল হোক বিলুপ্তি হবে এটা নিশ্চিত। তার মানে এই নয় যে তা থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে। আমাদের জীবনের বাঁচা মরার মত এটা আমরা কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারবনা। কিন্তু আমরা যা করতে পারি সেটা হল সময়ের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার। বিশেষ করে যখন আমরা জানি পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে হবে।
No comments